Our Sherpur

গোপন নায়ক উপন্যাস, সাগর আহমেদ

লেখকঃ সাগর আহমেদ

সব সময় একটা জিনিস ভাবি, দুঃখ কেনো আমার পিছু ছাড়ে না। পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায়-পাতায় পাওয়া যায়, দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার। হয়ত এ কথাটা আমার বেলাতেও সত্য!
দুঃখেরও বুদ্ধি আছে! সেও ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়েছে। আর তাইতো আমার মত সরল-সোজা, দুর্বল, হাবাগোবা প্রকৃতির ছেলেকে তার পছন্দ! বিশ্বাস করো, সত্যি করে বলছি। আমি দুঃখকে একেবারেই দু’চোখে দেখতে পারিনা। বরং আমি তার নামটাই শুনতে পারি না। তারপরও দেখবে, পথে-ঘাটে, হাট-বাজারে, ঘরে-বাইরে সারাক্ষণ আমার সাথে লেগেই থাকে!
কত কান্নাকাটি করলাম! একটু যদিও তার দয়া-মায়া থাকতো! আর আমাকে ছাড়লোই না। আমার এই লেখাগুলো পড়ে তোমার হয়ত তেমন কোন প্রতিক্রিয়া হলো না! বিশ্বাস করো, আমার দু’চোখের কোনায় কখন যে পানি এসে জমা হয়ে গেছে..! এইতো! লেখতে লেখতে সেটাও চোখ বেয়ে নাকের পাশ দিয়ে নিঃশব্দে পড়ে গেলো।
এই তো জীবন। হা, আমি এমন জীবনেরই একজন প্রতিনিধি।
বিশ্বাস করো, আমার পকেটেও একটা ম্যানিব্যাগ থাকে। সেটা শুধুমাত্র পকেটের শোভা। মানুষকে দেখানো ছাড়া আর কিছু না। যখন রাস্তায় বের হই, গায়ের পোশাক আর হাতে দামি মোবাইল দেখে তুমিও ভাববে, হয়ত আমি কোন ধনী ঘরের বা চাকুরীজীবী বাপের ছেলে। কিন্তু প্রকৃত সত্যটা জানলে তুমিও আফসোস করবে, দুঃখ করবে!
তারপরও দুঃখগুলো আজও আমাকে ছেড়ে গেলো না। কতটা পাষাণ হলে এতটা বেহায়া হওয়া যায়! আমি আমার সাথে লেগে থাকা দুঃখগুলো থেকে তা শিখেছি।
আমি যেকোনো জায়গায় সংকোচ ছাড়াই বলি, আমি কৃষকের সন্তান। কত স্বপ্ন নিয়ে শহরে এসেছি লেখাপড়া করতে। আর আমাদের মত সন্তানদের মা-বাবা কত কষ্ট করে আমাদের লেখাপড়ার জন্য টাকা পাঠায় তার ইতিহাস তো আমাদের মুখস্থ।
এই যে দেখো, আমার পরণের প্যান্ট আটশত টাকা, টিশার্টের দাম পাঁচশত টাকা আর মোবাইলের দাম নয় হাজার টাকা। দেখে ভাবছো, বাপরে, অনেক দামের জিনিস পড়ে দেখছি ছেলেটা। আমি অনার্স ২য় বর্ষে পড়ছি। কেবল হাতে অ্যানড্রয়েড মোবাইল পেলাম। কষ্ট লাগতো খুব। যখন আমার বন্ধুরা, এমনকি আমার বয়সে অনেক ছোট তারাও অ্যান্ড্রয়েড চালাতো। সেইখানে আমি আমার মূল্যবান বাতাম সেট পকেট থেকে বের করার সাহস পর্যন্ত পেতাম না! এমনকি কল আসলেও তাদের সামনে ধরতাম না। দুরে গিয়ে কথা শেষ করে তারপর তাদের সামনে আসতাম। পাছে আবার নিজের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়!
আর এই প্যান্ট-টিশার্টের কথা বলছো? তাহলে এর ইতিহাস বলি। শুনো- ওই বার বাড়িতে গিয়ে মাকে বললাম, “মা, আমি তো এখন অনার্সে পড়ি। শহরের মানুষদের সাথে চলতে হয়। বুঝই তো, দামি কাপড় না পড়লে তাদের সাথে চলা যায় না! মানুষ কি বলবে? দেখো, একটা দামি মোবাইলও নাই। আশেপাশের ছোট ছেলে মেয়েরা পর্যন্ত আজ কত দামি দামি মোবাইল চালায়! তুমিও তো দেখো! আর কত মা এমনে চলবো? মা…. ওমা?”
মা বলে, “চেষ্টা তো করতেছি বাবা, টাকা রেডি করার। আর কয়দিন সবুর কর। বড় মুরগীটার দশটা বাচ্ছা প্রায় বেঁচার উপযুক্ত হইছে। সামনের সপ্তাহে পাইকার আসলে সবগুলো বেঁচে তোকে টাকা দিবো নে! তখন ভালো দেখে কাপড় কিনিস। ভাবছিলাম, এই বাচ্ছাগুলো বেঁচে বিছানার চাঁদর, একটা মশারি, চেয়ার টেবিল কিনতাম! দেখস না, কতবার যে সেলাই করলাম আর জোড়া লাগাইলাম, আর পারি না। ঘরের ভিতরে মানুষ আসলেই তো লজ্জা লাগে!”
আমি তখন বাচ্ছা ছেলের মত নাছোড়বান্দা ভাব নিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরি। “মা, এগুলো তো তেমন কেউ দেখতেছে না। এসব পড়েও কেনা যাবে। আমাকে তো সবাই দেখে। আগে আমারটা লাগবে। মা, মা, মা।”
মা বলে, “হইছে ছাড়। বলছি তো, কাপড়ই আগে কিনিস।
আমি বলি, “মা। মোবাইলটা কি আর আমার কেনা হবে না?” মা তখন আশার বাণী শোনায়। “কিনবি তো, সবি কিনবি। বাড়ির সামনে তো দেখছোস, ঝোপঝাড় পরিস্কার করছি। এইবার বৃষ্টি আসলেই, লালশাক, মুলাশাক, ডাটাশাক, বেগুন, কাঁচামরিচ, লাউ আর শিমের বীজ বুনবো। এসব বেঁচলেই দেখবি টাকা হয়ে যাবে। এতো চিন্তা করিস না। মনোযোগ দিয়ে পড় বাবা।”
“মা, অনেকবার কিন্তু তোমার এসব কথা শুনছি। এইবার কিন্তু আর মানবো না। এবার কিনে দিতেই হবে!”
তখন মায়ের মুখে একটা হাসি দেখি। সে এক রহস্যময় হাসি। আমার দ্বারা এ রহস্য উৎঘাটন সম্ভব নয়। স্রষ্টাই জানেন, তাঁর হাসিটার আসল খবর!

Leave a Reply

Scroll to Top