লেখকঃ সাগর আহমেদ
তুমি হয়ত মেসের ছেলে-মেয়েদের খাওয়া দাওয়া, খরচপাতি, চলাফেরা সম্পর্কে জেনে থাকবে। তারা মারাত্মক অভিনয় করতে জানে! দুখের মধ্যে থেকেও সুখে থাকার অভিনয়। সে হিসেবে তারা প্রত্যেকেই নায়ক! তবে তারা গোপন নায়ক। নিজেই অভিনয় করে, নিজেই তা দেখে। নিজেই হাসে, নিজেই কাঁদে। সে গোপন নায়কের সুনিপুণ অভিনয় কেউ জানতেও পারে না। বুঝতেও পারে না। কিন্তু তাদের সবার অভিনয়ের গল্পটাতে দারুণ মিল আছে। আর আমিও কিন্তু তাদের একজন।
তুমি হয়ত জানো কিনা। তবে বিশ্বাস করো- তারা পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য দুই-তিন কিলোমিটার রাস্তা মনে মনে গান গাইতে গাইতে অনায়াসেই হেটে চলে যায়। তুমি হয়ত তাদের দেহের মধ্যে ক্লান্তির আভাস খুঁজে পাবে, কিন্তু তাদের মনটা এরই মধ্যে এসবে অভ্যস্ত হয়ে সয়ে গেছে। মনের শক্তির জোরেই তাদের দেহ চলে।
এভাবে একটু পরেই তুমি আবার তাদের মুখে শুনবে, গাড়িতে বা রিক্সায় উঠার কি দরকার। চলো, আলাপ করতে করতে হেটেই ফিরে যাই।
তারা পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য রিক্সা বা অটো ড্রাইভারের সাথে তর্কে জড়ায়। তুমি একে কি বলবে! সেটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু আমি তাদের পাঁচ টাকা বাঁচানোর মধ্যে ভবিষ্যতের কোন কাজের খরচের সঞ্চয় খুঁজে পাই। আর আমি এমন জীবনেরই একজন মানুষ। হয়ত আমার এসব কষ্টের কাহিনী শুনে তোমার কষ্ট লাগেনি! হয়তবা, কষ্টের কথাগুলো আমি স্বার্থকভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারি নি। ব্যর্থতার দায় আমি একা নেবো না! তোমারও ব্যর্থতা থাকতে পারে। হয়তো, তোমার মনটা এসময় আনন্দে আছে অথবা তুমি কিছুটা পাষাণ!
সন্ধ্যায় মেসে ফিরছিলাম। পকেটে হাত দিলাম, পাঁচ টাকা আছে। যা হোক, আছে তো! আর বলো না, এক স্যারের সাথে দেখা। ঘন্টাখানেক আড্ডা দিলাম। সাথে চা, বিস্কুট, পান তো আছেই। উঠে আসার সময় স্যার বললো, “বিলটা আমিই দেই।” আমিও সম্ভ্রান্তের ভাব নিয়া বললাম, “না স্যার, আমিই দেই।” দেখলাম, উনি আর কোন প্রতিক্রিয়া দেখালেন না। বুঝে ফেললাম। শেষ পর্যন্ত বিলটা আমাকেই দিতে হচ্ছে! পঞ্চাশ টাকা দিলাম। পাঁচ টাকা ফেরত পাইছি! পকেটে আর টাকা ছিলো না। ভাগ্যিস, আর বেশি খাইনি। তাহলে মারাত্মক বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তাম! নিজের সম্মানটা স্যারের সামনে রাখতে পেরেছি বলে নিজেকে ধন্য মনে করলাম!
মনে মনে সংকল্প করলাম, তারপর থেকে আর চা ছাড়া অন্য কিছু খাবো না। এর আগেও কয়েকবার এরকম পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। যাই হোক, বুদ্ধিমান বলেই, সংকল্পটা দেরীতে হলেও করলাম।
রাস্তা দিয়ে আসার সময় পাশে হোটেলের দিকে নজর গেলো। গরম গরম পেয়াজি আর সিঙ্গারা। আমি সচারাচর এগুলো খাইনা। তবে আজ কেন যেন মন চাইছিলো! ভাবতে ভাবতে অনেক পথ পার হয়ে এসে পড়েছি। আমি জানি, সব খানেই এগুলো পাঁচ টাকা করে। পকেট থেকে পাঁচ টাকা বের করতে করতে হোটেলের দিকে চললাম। গিয়েই পাশে বসে থাকা লোকটাকে বললাম, “ভাই একটা সিঙ্গারা দেন তো!” লোকটা কাগজে পেঁচিয়ে দিতে যাবে এমন সময় ভাবলাম যে, দামটা জিজ্ঞেস করা দরকার। “ভাই, সিঙ্গারার দাম কত?”
“দশ টাকা”
দাম শুনে আমার মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেলো। আত্মাটাও ছোট হয়ে গেলো। এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে কখনো ভাবিনি। নরম গলায় আস্তে করতে বললাম, “রেখে দেন ভাই! ভাবছিলাম পাঁচ টাকা!”
আর কথা বাড়ালাম না! কষ্টটা লুকিয়ে মুচকি একটা কম দামি হাসি দিয়ে দ্রুত সরে পড়লাম। যতক্ষণ ওখানে থাকবো, আশে পাশের লোকেরা আমার সম্পর্কে কি রকম দামি দামি অনুমান করবে তাতো বুঝতেই পারছো! মেসে ফেরা পর্যন্ত কোন কথা বলিনি তখন। শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। কারণ, আমার সহায় কর্তা ঐ খানেই থাকেন!
প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন