শেরপুর জেলার পেশা

শেরপুর জেলার পেশা ‍ও বৃত্তির একাল-সেকাল

রফিক মজিদ
কবি ও সাংবাদিক রফিক মজিদ

পৃথিবী সৃষ্টি কাল থেকে অর্থাৎ মানব সৃষ্টির পর থেকেই মানুষ যখন তার নিজের বিভিন্ন চাহিদার কথা অনুভব করতে বা বুঝতে চেষ্টা শুরু করে সম্ভবত তখন থেকেই পেশা ও বৃত্তির উৎপত্তি হয়| কেননা মানুষ যখন তার খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষি কাজে লিপ্ত হয়েছে তখন সৃষ্টি হয়েছে কৃষি পেশার। সাগর, নদী বা জলাশয়ে মাছ ধরার চাহিদার কারণে মৎস্যজীবী পেশার সৃষ্টি।

ঠিক এভাবে মানুষ তার জীবনের বিভিন্ন চাহিদা বা প্রয়োজন মেটাতে গিয়েই সৃষ্টি করেছে নানা পেশা ও বৃত্তির। তবে এ পেশা ও বৃত্তি তৈরির ধারাবাহিকতা আধুনিক কম্পিউটার যুগে এসেও অনেক পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংকোচন এবং বিলুপ্ত হয়েছে মানুষেরই প্রয়োজনের ধরন বা চাহিদার পরিবর্তনের কারণে। এই পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সংকোচন এবং বিলুপ্ত যুগে যুগে হয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতেও হবে।

Products list of Our Sherpur
শেরপুর জেলার যেসব পণ্য আওয়ার শেরপুর এ পাওয়া যায়।

ইতিহাস

শেরপুর অঞ্চল প্রাচীন কালে কামরুপ রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। সে সময়ে কামরুপ রাজ্য ছোট ছোট প্রদেশে গারো, হাজং, কোচ সামন্তরাজাদের শাসনে ছিল। পরবর্তীতে শেরপুর অঞ্চলের শাসন ক্ষমতা কোচ রাজাদের হাত থেকে মুসলমানদেরে হাতে চলে আসে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে শেরপুরের শাসনভার বৃটিশদের করায়ত্ত হয়। এরপর ভারত বিভক্তির পর আসে পাকিস্তান আমল। সর্বশেষ মহান মুক্তিযুদ্ধের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের একটি জেলার মর্যদা পায় এই শেরপুর অঞ্চলটি|

বর্তামনে এই শেরপুরের ৮০ শতাংশ লোকই কৃষিজীবী। আদিকাল থেকেই স্থানীয় অধিবাসী বৈচিত্র্যময় কিছু পেশার সংগে জড়িত ছিল। বর্তামনে এসব পেশার অনেকগুলো বিলুপ্ত হয়েছে এবং অনেক লোকজন এখনও অতিকষ্টে ধরে রেখেছে তাদের ঐতিহ্যকে। এসব পেশার লোকজন সেই আদিকাল থেকেই নিগৃহীত ও বঞ্চিত হয়ে আসছে। তবুও সমাজের কাছে এদের কোন অভিযোগ নেই। নেই কোন দাবী-দাওয়া, চাওয়া-পাওয়া। এরা নীরবে নিভৃতে তাদের পেশার মাধ্যমে সেবা দিয়ে যাচ্ছে সমাজের তৃণমুল থেকে সুউচ্চ স্তরে।

এ অঞ্চলের আদিকাল থেকে যেসব পেশার অস্থিত্ব চিহ্নিত করা গেছে এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কাঠমিস্ত্রি, রাজমিস্ত্রি, মৎস্যজীবী বা জেলে, তাঁতি, কুমার, কুলু, কামার, নাগারচি, ঢুলি, ঠাঠারু, মাইটা, পাচক, খানশামা, বাবুর্চি, নাপিত, ধোপা, কোচম্যান, বেহারা সর্দার, মাঝি, লস্কর, ডোম, গাড়রিয়া, ভর, কাশ্মিরা, নটুয়া, গাড়িয়াল, লাঠিয়াল, চুরিহার, পাচি, হালখেরে, মুগম, সোনার প্রভৃতি। 

কৃষক
কৃষক-কৃষি

কিন্তু যুগে যুগে পটপরিবর্তন, আধুনিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন, পরিবেশ বিপর্যয়, জলবায়ুর পরিবর্তন, যুগের চাহিদায় জীবন ধারণের তাগিদে উল্লেখিত পেশার অনেকেই এখন তাদের বাপ-দাদার বা পৈত্রিক পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় যেতে বা পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে।  ফলে নতুন করে সৃষ্টি হয়েছে বিভিন্ন পেশা ও বৃত্তির।

শেরপুর জেলার পেশা ‍ও বৃত্তির সেকাল

শেরপুর অঞ্চেলে স্বাধীনতার পর থেকে নতুন করে যে সব পেশার সৃষ্টি হয়েছে এসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- চাতাল শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক (রিক্সা, ঠেলা, ভ্যান, ও যন্ত্রচালিত বিভিন্ন প্রকার গাড়ীর চালক ও শ্রমিক) বিড়ি শ্রমিক, ইট ও পাথর ভাঙ্গা শ্রমিক প্রভৃতি। উল্লেযোগ্য পেশার সঙ্গে ইতোমধ্যে প্রচীনকালের অনেক পেশার লোকজন সম্পৃক্তও হয়েছে বাচাঁর তাগিদে। প্রচীন কালের যেসব পেশার লোকজন এখন বিলুপ্ত বা চোখে পড়ে না তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য পেশাগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ : 

ঠাঠারু

এ পেশার লোকজন বসবাস করতো শেরপুর সদরের পাকুরিয়া, নবীনগর, এবং ঝিনাইগাতী উপজেলার হাসলিবাইতা, ঘাঘড়া গ্রামে। এরা প্রচীন কালের ইমিটেশন বা ব্রোঞ্জ, পিতল, সিলভার দ্বারা গহনা তৈরী করতো। যে সব গহনা তৈরি করতো সে সব গহনার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হাসলি, বাজু, খাড়া বাজু, মেয়েদের কোমরের বিছা, কানের ঝাপসা ইত্যাদি। এসব গহনা এখন আর কেউ ব্যবহার করে না। ঠাটারুরা এখন অন্য পেশায় চলে গেছে। আবার কেউ কেউ সোনার (স্বর্ণ ও রুপার অলংকার তৈরী করে যারা) পেশার সাথে সম্পৃক্ত।

গাড়রিয়া

এরা ছাগল ভেড়া পালন করতো এবং এসব পশুর লোম দ্বারা কম্বল প্রস্তুত করতো। ধারণা করা হয়, এরা জেলার প্রত্যন্ত চরাঞ্চলে ও গারো পাহাড় এলাকায় বসবাস করতো। 

বেতের কাজ

হিন্দু ধর্মীয় নম:সূত্র সম্প্রদায়রা তৎকালে চমৎকার বেতের কাজ করতো। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলো পাটি, মোড়া, চেয়ার, দোলনাসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র। শেরপুর অঞ্চল এক সময় এ শিল্পের জন্য বেশ প্রসিদ্ধ ছিলো। বেতের উৎপাদনও হতো প্রচুর। বেত উৎপাদনের কারণে শেরপুর সদর উপজেলায় একটি গ্রামের নামকরণ করা হয় বেতমারী। কিন্ত সে সব বেত শিল্পের সাথে জড়িত পেশার লোকজন এখন দেখা যায় না। তবে এদের অনেকেই এখন বাঁশ-বেত ও কারুশিল্পের পেশায়, আবার অনেকেই ভিন্ন পেশায় নিয়োজিত হয়েছে।

ভর

এরা শূকর পালন করতো। শেরপুরের গারো পাহাড় এলাকায় এক সময় গারো বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন প্রচুর শূকর পালন করতো। নিজেরা খাওয়ার জন্য এবং  বিক্রির জন্য। এছাড়া তৎকালীন হিন্দু জমিদাররাও শূকর পালন করতো। আর এ লালন পালন কাজে লিপ্ত ছিল যারা, তাদেরকে ’ভর’ বলা হতো। বর্তামানে জমিদারী নেই, তাই ভরদের দেখা যায় না। তবে গারোদের কেউ কেউ নিজের খাওয়ার জন্য শুকর পালন করছে নিজেরাই। 

মুগম

এদের কাজ ছিল শেয়াল মরা। গ্রামে-গঞ্জে বিভিন্ন ফসলের ক্ষতি সাধন করতো পন্ডিত মশাই খ্যাত শেয়াল। আর তাই তৎকালে শেয়াল মারার জন্য মুগম নামে এক ধরনের পেশাজীবী লোক ছিল। কিন্তু বর্তমানে শেয়ালের অস্তিত্বই বিলুপ্তির পথে। ফলে মুগম পেশার লোকজনের অস্তিত্ব নেই। 

লাটাউর

কুন্তিগীর বা লাটাউরদের শেরপুর অঞ্চলে বেশ প্রভাব ছিল। গ্রামে গঞ্জে কুস্তি খেলার ব্যাপক জনপিয়তা ছিল। কিন্তু পর্যায়ক্রমে ফুটবল, ক্রিকেট খেলার জনপ্রিয়তা বাড়ার কারণে কুস্তি খেলার কদর কমে যায় ফলে লাটাউররা পেশা ছেড়ে দেয়। 

গাড়িয়াল

এরা প্রচীন কাল থেকে শহর বন্দর গ্রামে নিজেদের গরু-মহিষও ঘোড়ার গাড়ী করে বিভিন্ন মালামাল বহন করতো। কিন্তু আধূনিক যুগের মোটর যানের কাছে তাদের অস্তিত্ব এখন আর খুব দেখা যায় না।

শেরপুর অঞ্চলে জমিদারী প্রথা চালুর সময় যে সব পেশার লোকজন ছিল বা পেশা-বৃত্তির সৃষ্টি হয়েছিল তার বেশির ভাগই জমিদারী প্রথা বিলুপ্তির সাথে সাথেই ওইসব পেশাও বিশুপ্ত হয়ে গেছে। বাপ-দাদার পেশা ছেড়ে চলে যায় অন্য পেশায়। উল্লেখিত পিশার মধ্যে নাগরাচি, পাচক, খানশামা, কোচম্যান (ঘোড়াগাড়ীর চালক) বেহারা সর্দার, লস্কর, কাম্মিরা (নাচ-গান করে মনোরঞ্জ করতো)। এছাড়াও জমিদার আমালে এক শ্রেণীর সুতার ছিলেন যারা কাঠের কাজের পাশাপাশি হাতির দাঁত ও মহিষের শিং দিয়ে পাটি, খড়মসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরী করতো। কিন্তু এখন তাদের আর দেখা যায় না।

আদিকাল থেকে বর্তামন পর্যন্ত অনেক পেশার লোকজন এখনও নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও তাদের বাপ-দাদার পেশা ধরে রেখেছে। আবার এসব পেশার মধ্যে পরিবর্তনও এনেছে কেউ কেউ। প্রাচীন কালের অনেক পেশার কদরও বেড়েছে এই আধুনিক যুগে। কদর বেড়েছে যেসব পেশার সেসব পেশার মধ্যে উল্লেযোগ্য হলো রাজমিস্ত্রি, কাঠমিস্ত্রি, বাঁশের কারুকাজ, হস্তশিল্প ‍ও কারুশিল্প, বাবুর্চি, নাপিত, ধোপা, প্রভৃতি। যদিও এদের ভগ্যের পরিবর্তন হয় না কখনও। তবুও এরা মানুষের চাহিদার উপর নির্ভর নিজ নিজ পেশায় টিকে আছে। রাজমিস্ত্রি কাজে হিন্দু-মুসলিমসহ সব ধর্মের লোক জড়িত। কাঠের কাজ যারা করে তারা স্থানীয় ভাবে সুতার বা নমসূত্র বলে পরিচিত। অপরদিকে বাঁশ ও বেতের কাজ করতো পাটন, গারো, ডালু, হাজং ও নিম্ন শ্রেণীর হিন্দুরা। যেসব পেশার লোকজন নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও যুদ্ধ করে বেঁচে আছে সে সব পেশা হচ্ছে : 

শেরপুর জেলার পেশা ‍ও বৃত্তির একাল

রাজমিস্ত্রি

প্রাচীনকাল থেকেই এদের কদর রয়েছে। রাজা-বাদশার প্রাসাদ নির্মান করতো বলে এদেরকে রাজমিস্ত্রি বলে ডাকা হয়। তবে এখন আধুনিক প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি দিয়ে কাজ করায় ঝাক্কি ঝামেলা অনেক কমে গেছে। জেলার সর্বত্রই এদের দেখা পাওয়া যায়। প্রাচীনকালের স্থানীয় জমিদাররা ভিনদেশ থেকে রাজমিস্ত্রি এনে প্রাসাদ নির্মাণের কাজ করলেও এ পেশার সাথে অত্র এলাকার অনেক লোকই জড়িত ছিল। তবে পূর্বের সেই রাজমিস্ত্রি বংশের এখন কাউকে খুঁজে পাওয়া না গেলও বাচাঁর তাগিদে অনেক মানুষ এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত হয়েছে। 

কাঠমিস্ত্রি
কাঠমিস্ত্রি

কাঠমিস্ত্রি

এদের মাঝেও এখন আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। এক সময় কাঠমিস্ত্রি বা সুতারদের নিপুন হাতের কারুকাজ মানুষকে শৈল্পিক জগত নিয়ে যেতো। যদিও এ অঞ্চলে জমিদার আমলে তাদের মাধ্যমে চীন দেশসহ বিভিন্ন দেশের কারিগর এনে বাড়ি ঘরের বিভিন্ন নকশার কাজ করাতো। তথাপি শেরপুর অঞ্চলের কাঠমিস্ত্রি বা সুতারদের নকশা বা কারুকাজের সুনাম রয়েছে। বর্তমানে আধুনিক যুগে কাঠের বিকল্প হিসেবে নানা দ্রব্যের ব্যবহার হওয়া এবং কাঠের দুষ্পাপ্যতার কারণে কাঠের কাজ কমে গেছে। ফলে কাঠমিস্ত্রিদের সেই স্বর্ণযুগ এখন নেই। তবে এদের অস্তিত্ব জেলার সর্বত্রই রয়েছ।

কুমার

কাদা মাটি দিয়ে হাতের সুনিপুন ছোঁয়ায় হাঁড়ি-পাতিল সহ গৃহস্থলির নানা আসরারপত্র তৈরী করাই কুমারদের কাজ। কুমারদের কেউ কেউ পাল বলে ডেকে থাকে। আধুনিক প্রযুক্তি ও বিভিন্ন ধাতব দ্রব্যের তৈরী হাঁড়ি-পাতিল, থালা-বাটিসহ গৃহস্থলির সবরকম জিনিসপত্র তৈরী হওয়ায় কুমারদরেও সেই সোনালী দিন এখন আর নেই।

শেরপুর সদর উপজেলার বয়ড়া নামক স্থানে চল্লিশ থেকে ষাটের দশকে টাঙ্গইল জেলা থেকে কয়েকঘর কুমার সম্প্রদায় বসতি স্থাপন করে। পরবর্তীতে ওই গ্রামের একটি অংশের নাম হয় ’বয়ড়া পালপাড়া’। এছাড়া শহরের শেরীপাড়াতেও কুমারদের অস্থিত্ব থাকলেও বর্তমানে নেই। তবে জেলার বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলে কুমার পেশার লোকজন নানা প্রতিকুলতা মধ্যে নিজিদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে।

শেরপুর সদরের বয়ড়া পাল পাড়ার কামারদের দিনকাল ভাল যাচ্ছে না বিধায় তাদরে ভবিষৎ প্রজন্মকে আধুনিক পেশার সাতে সম্পৃক্ত করার প্রবণতা দেখা গেছে। ওখানে এখানও কয়েকঘর কুমার পরিবার রয়েছে তাদের পৈত্রিক পেশাকে টিকিয়ে রাখতে।

নাপিত

প্রাচীন কাল থেকেই দেখা যেতো গ্রামগঞ্জের বিভিন্ন হাট বাজারে গাছের ছায়ায় বসে ক্ষুর-কাঁচি নিয়ে নাপিতরা মানুষের চুল দাড়ি কাটতো। কোন কোন নাপিত বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল-ডালের বিনিময়ে চুল-দাড়ি কাটতো। নাপিতকে কেউ কেউ ’নরসুন্দর’ বলে থাকেন। নাপিতদের পেশায় বর্তমানে বৈচিত্র ও আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে। তারা এখন শহরের বিভিন্ন স্থানে আধুনিক ডেকারেশন করে এমনকি এয়ারকন্ডিশনার বা এসি লাগিয়ে দোকান বা সেলুন সাজিয়ে ব্যবসা করছে। তবে এদের পাশাপাশি গ্রাম-গ্রঞ্জের হাট বাজারে পূর্বের সেই সনাতনি নাপিত বা নরসুন্দর কে এখনও দেখা যায়। তবে এদের দিনকাল খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। 

ধোপা

জমিদার আমল থেকেই শেরপুর অঞ্চলে ধোপাদের কদর রয়েছে। এই আধুনিক যুগের নানা প্রযুক্তি যেমন- ইলেট্রনিক ইস্ত্রি, ওয়াসিং মেশিন বের হলেও তাদের কাজের গতি কমেনি। শহরের শেরীপাড়া, ধোপাপাড়াসহ জেলার সর্বত্রই এদের অস্তিত্ব রয়েছে। তবে এদের ভবিষৎ প্রজন্মকে আধুনিক যুগের পেশার সাথে সম্পৃক্ত করার প্রবণতা দেখা যাওয়ায় এ পেশার লোকজন ক্রমেই কমে যাচ্ছে।

বাবুর্চি বা পাচক

ভোজন প্রিয় বাঙ্গালীর চিরচেনা বাবুর্চিদরে কদর কমেনি। ফলে এ পেশার লোকদের মাঝে এসেছে আধুনিকতা ও বৈচিত্র। বিয়ে, পিকনিক বা সামাজিক কোন আপ্যায়ন-অনুষ্ঠানের আয়োজন হলেই ডাক পড়ে বাবুর্চিদের। শেরপুরে জমিদার আমল থেকেই বাবুর্চিদের কদর রয়েছে। ইদানীং সামাজিক চাহিদা ও বাচাঁর তাগিদে অনকে হতদরিদ্র লোক নতুন করে এ পেশার সাথে সম্পৃক্ত হচ্ছে। আবার কেউ কেউ এ পেশা ছেড়ে আধুনিক পেশায় চলে যাচ্ছে আর্থিক সচ্ছলতা বাড়াতে।

বাঁশের কাজ
বাঁশের কাজ

বাঁশ-বেত ও কারুশিল্প

বাঁশ-বেতের সঙ্গে যারা জড়িত তাদরে দিনকাল এক সময় খারাপ গেলেও আধুনিক যুগের চাহিদার কারণে এদের কদর বাড়তে শুরু করেছে। জেলার শ্রীবরদী উপজেলার পাইকুড়া গ্রামের প্রায় সকল মানুষ যোগ দিয়েছে বাঁশের তৈরী বিভিন্ন আসবাবপত্র তৈরীতে। সেখানে বর্তমানে প্রায় প্রতি ঘরে ঘরে নারী পুরুষ বাঁশের তৈরী সরঞ্জামের কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। এছাড়া জেলার বিভিন্ন হস্তশিল্প প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন পেশার মানুষ বাঁশ-বেত ও কারুশিল্পের সঙ্গে নতুন করে সম্পৃক্ত হচ্ছে।

মৎস্যজীবী বা জেলে

দেশের হাওড়-বাওড়, নদী-নালা, খালবিল শুকিয়ে যাওয়ায় এবং নদ-নদীর নাব্যতা হ্রাস পাওয়ায় মাছে-ভাতে বাঙ্গালীর সেই মাছ এখন আর নেই। ফলে মৎস্যজীবী বা জেলে, নিকারী এবং ডালাতিয়াদের এখন দিন ভাল যাচ্ছে না। 

তাঁতি

শেরপুর অঞ্চল এক সময় তাঁত শিল্পের জন্য বেশ প্রসিদ্ধ ছিল। শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া সহ বেশ কিছু চরাঞ্চলে তাঁতি সম্প্রদায়রা বেশ দাপটের সঙ্গে এ কাজ করতো। কিন্তু ওই তাঁত শিল্প অর্থাভাবে এবং আধুনিক প্রযুক্তির কাছে মার খেয়ে এ শিল্প পেশার লোকজন এখন অন্য পেশায় চলে গেছে।

কুলু

ঘানি শিল্পের সঙ্গে জড়িত কুলু পেশার লোকজন। কিন্তু সেই ঘানি শিল্প এখন বিলুপ্ত হওয়ার পথে। তাই শেরপুরের যে কয়টি কুলু পরিবার ছিল তাদের বেশির ভাগই যন্ত্রচালিত ঘানির কাছে মার খেয়ে বিলুপ্ত হতে চলেছে। শেরপুরের বিভিন্ন অঞ্চলে ও শহরে কুলু পাড়া নামাক মহল্লা থাকলেও সেই কুলু পড়ার কুলুরা রেখেছে মানবেতর জীবন যাপেন করে।

মাঝি

নাদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। শেরপুরেও নদী-নালার অভাব নেই। কিন্তু আধুনিক সভ্যতায় দ্রুত যোগযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বিভিন্ন আধুনিক ব্রীজ, কালভার্ট তৈরী হওয়ায় নদী-নালা পারাপার হতে খেয়া বা মাঝির প্রয়োজন হয় না। শেরপুরে এখন এ পেশার লোকজন খন্ডকালীন সময়ের জন্য জড়িত। বাকী সময় ব্যয় করে অন্য পেশায়। কেউবা জড়িয়ে পড়েছে কৃষিকাজে, কেউ বা দিনমজুরে। বর্ষায় নদী-নালা, খাল-বিল, সড়ক-মহাসড়ক তলিয়ে গেলে ওই মাঝিরা খেয়া পারা-পারে লিপ্ত হয়। বর্ষা চলে গেলেই ফের অন্য পেশায়।

কামার

এই আধুনিক যুগেও অনেক কাজে কামারের প্রয়োজন হয়। তবে সমাজে এই পেশার গুরুত্ব থাকলেও এ পেশার সঙ্গে জড়িতদের আর্থিক বা ভাগ্যের কোন উন্নয়ন হয়নি আজো। শেরপুর কামার শিল্পটার এক সময় যে কদর ছিল তা জেলার কামারের চর, কামার পাড়া, কামার খন্দি প্রভৃতি গ্রামের নাম শুনেই বোঝা যায়। তবে আধুনিক প্রযুক্তির তৈরী দা, বদি, কাঁচি, চুরির কারণে কামারদের পেশায় অনেক স্থবিরতা এসেছে।

মাইটা

এরা ক্ষেতের বা অনাবাদ জমি থেকে মাটি কেটে গরুর গাড়িতে করে মাটি বিক্রি করতো। কিন্তু আধুনিক যুগে নদীর বিট বালুর প্রচলনে এখন আর কেউ এই মাটি কিনে না। ফলে তারা মাটি বিক্রী করতে না পেরে অন্য পেশায় ঢুকে গেছে।

পাচি

এদেরকে কোথাও গাছি বলে। অর্থাৎ এরা গাছ কেটে খেজুরের রস তৈরী করে। শেরপুর অঞ্চলে পাচিদের এখন খুজে পাওয়া ভার। তবে ফরিদপুর এলাকার গাছিদের ইদানীং শেরপুরে দেখা যায়। এরা শীতকালে খেজুরের গাছ কেটে রস তৈরী করে থাকে। এছাড়া গ্রাম গঞ্জের খেজুরের গাছের সংখ্যাও কমে যাওয়ায় পাচি বা গাছিদের এখন কদর কমে গেছে।

দাই

সভ্যতা ও মেডিকেল সাইন্সের যুগে দাই এর স্থান দখন করেছে ডাক্তার ও নার্সরা। তবে গ্রামে গঞ্জে এমনকি শহরের কোথাও কোথাও এ দাই এর কাজ করতে দেখা যায়। তবে তাদরে সেই পূর্বের ন্যায় কদর নেই। সনাতনি দাইদের অনেকেই এখন আধুনিক পদ্ধতির ট্রেনিং দিয়ে দাইর কাজ করছে। তবে সনাতনী দাইদের অস্থিত্ব প্রায় বিলুপ্তির পথে।

ঢুলি

এরা বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে ঢোল বাজিয়ে, বাঁশির সুরে সুর তুলে মানুষকে আনন্দ এবং সামাজিক অনুষ্ঠানকে আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। কিন্তু আধুনিক যান্ত্রিক যুগে ঢুলিদের কদর কমে গেছে। তবে হিন্দু ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বিয়েতে ঢোলের বিকল্প না থাকায় এরা এখনও টিকে আছে। তাদের এসব অনুষ্ঠানাদি মৌসুমভিত্তিক বিধায় এরাও খুব ভাল নেই। শেরপুর শহরের শেখহাটী মহল্লা এবং পাকুরিয়া গ্রামে ঢুলি শহরের বেশ প্রসিদ্ধ ও জনপ্রিয় ছিল। তারাও এখন অন্য পেশার সঙ্গে জড়িত হলেও কোন বায়না পেলে চলে আসে তাদের স্বপেশায়।

চুরিহার

এরা শহর বন্দর গ্রামে চুরি বিক্রি করতো। এখনও অনেকেই চুরি বিক্রি করে। তাবে তারা শেরপুরের তৎকালীন চুরিহারা পেশার লোকজন নয়। এরা জাতে সান্দার। চুরিহারা নামে নালিতাবাড়ী উপজেলায় একটি গ্রামের নামকরণ থেকে বোঝা যায় সমাজে এ পেশার লোকজনের একসময় বেশ প্রভাব বা বিচরণ ছিল। 

স্বর্ণকার

সোনার বা স্বর্ণকার কেউবা কর্মকার হিসেবে পরিচিত এ পেশার লোকজন এখন কঠিন সময় পার করছে। ইতোমধ্যে জেলার প্রায় অর্ধেক সোনার বা কর্মকার এ কাজ ছেড়ে দিয়ে কেউবা দেশের বাইরে কেউ বা অন্য পেশায় ঢুকে গেছে। বাকী যারা আছে তাদের এখন করুণ হাল। স্বর্ণ ও রুপার অত্যাধিক মূল্যবৃদ্ধি এবং দেশের বাইরে থেকে আমদানিকৃত আমদানী গহনার কারনে সোনার বা স্বর্ণকাররা এখন তেমন কাজ পাচ্ছে না।

শেরপুর সদর উপজেলার পাকুরিয়া, নকলা উপজেলার গনপদ্দী সহ প্রতি উপজেলাতেই কমবেশী সোনারদের বেশ ভাল অবস্থান ছিল। বর্তমানে স্থানীয় সোনার ও কর্মকািরদের পাশাপাশি বহিরাগত বা অন্য জেলা থেকে আগত সোনার বা কর্মাকারদের সংখ্যাও প্রায় অর্ধেক রয়েছে। কিন্তু ব্যবসা মন্দার কারণে কাজ নেই। ফলে স্থানীয় ও বহিরাগত সোনার বা কর্মাকারা ভাল নেই।

শেরপুর অঞ্চলটি ইতিহাস সমৃদ্ধ হলেও পেশা ও বৃত্তির ব্যাপারে কোন পুস্তিকা বা তথ্য সূত্র না থাকার কারণে এ অঞ্চলের আরো অনেক নাম না জানা পেশা-বৃত্তির লোকজন বিলুপ্ত হয়ে গেলেও তাদরে সম্পর্কে কোন তথ্য দেওয়া বা সমৃদ্ধ করা সম্ভব হলো না। তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এ লেখাটি অবশ্যই কিছুটা হলেও তথ্য সহায়ক হবে বলে আমি মনে করি। এছাড়া লেখাটি যদি কোন ভুল-ত্রুটি থাকে তবে এ ব্যাপারে পাঠকের সার্বিক সহযোগীতা চাইবো তথ্যগত ত্রুটি সংশোধনের জন্য।

Leave a Reply