Our Sherpur

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা ২-৫

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা ২-৫

জ্যোতি পোদ্দার

জ্যোতি পোদ্দার
লেখক: জ্যোতি পোদ্দার

সময় ১৯৭১। বাংলা ও বাঙালীর এক অগ্নিগর্ভ কাল। একুশে সংকলন ’রক্তের স্বাক্ষর’। রেজাউল ইসলামের প্রযত্নে শেরপুর মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদের স্মরণিকা।

কাঠ খোদায়ের প্রচ্ছদ করেছেন হাবিবুর রহমান। স্থানিক পর্যায়ে কাঠ খোদাই কাজ এটিই প্রথম। পরবর্তীতে বিজন কর্মকার চমৎকার কাঠ খোদাই প্রচ্ছদ বিভিন্ন স্মরণিকায় প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৭১ সালে ‘রক্তের স্বাক্ষর’ ছাড়া অন্যকোনো ছোটকাগজ শেরপুরে প্রকাশিত হয়নি। এই সাল বাঙালীর স্বাধীকার আন্দোলনে জীবন বাজির রক্তবর্ষ। ছাত্র সংসদের নেতৃবৃন্দ ঠিক নামেই সংকলিত করেছেন ’রক্তের স্বাক্ষর’। রক্তের স্বাক্ষরেই আমাদের এই বাংলাদেশ।

এই সংকলনে প্রবন্ধ লিখেছেন নিত্যলাল বনিক,সংগ্রাম চক্রবর্তী । গল্পে আখতারুজ্জামান, সুভাষ চন্দ্র ও রেজাউল ইসলাম। কবিতা লিখেছেন জায়েদা খাতুন, আহসান হাবীব শ্যামল আর দুলাল দে বিপ্লব।

কাল বৈশাখীর ঝড় দেখছ! কাল বৈশাখীর ঝড়?
বাতাসে উড়েছিল গো কত জীবনের স্বর।
ঘর আমার, তবুও আমরা নইকো ঘরের স্বামী
কতকাল আর দেখবো বল ওদের ষণ্ডামী।
          (একুশের ছড়াঃ উদয় শংকর রতন)

Products list of Our Sherpur
শেরপুর জেলার যেসব পণ্য আওয়ার শেরপুর এ পাওয়া যায়।

১৯৭২ সালে শেরপুর মহাবিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয় ‘ওরা মরনজয়ী’। শফিকুর রহমানের সম্পাদনায়। স্বাধীনতার পর এটিই প্রথম স্মরণিকা। সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান লিখেছেন–

ও আমারও ভাই ছিল
আমি বেঁচেই আছি
স্বাধীনতার মুক্ত বাতাসে
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে
শৃংখ্ল মুক্ত বীর জনতার মাঝে।
           (ভাই বুলবুল)

পরবর্তী বছর একুশে সংকলন ‘ওরা মরণজয়ী’ বের হয় আহসান হাবীব শ্যামলের সম্পাদনায়। লিখেছেন সংগ্রাম চক্রবর্তী, সুভাষ চন্দ্র বাদল, তালাপতুফ হোসেন মঞ্জু, শাহানা পারভীন মিনা ও আবদুস সোবহান।

’স্পন্দিত শোনিত’ (১৯৭৩) একুশের সংকলন। ভাষার মাস ও স্মরণিকা প্রকাশের চর্চা নিয়ে চমৎকার নিবন্ধ লিখেছেন অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নান। এই সংসদের ভি পি মুহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ লিখেছেন, “মুক্তির অভিষ্ঠ লক্ষ্যে পৌছাবার জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণতন্ত্রের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ করে ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ গঠন করতে হবে।” এই সংখ্যায় আরো  লিখেছেন, দিপ্তি কনা সাহা রাবিউল রহমান আক্তারুজ্জামান, নিত্যলাল বনিক প্রমুখ। সস্পাদক সংগ্রাম চক্রবর্তী লিখেছেন “মহান ভাষা আন্দোলন ও আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি” বিষয়ক চমৎকার প্রবন্ধ। তিনি স্বাধীনতার পূর্বাপর শেরপুরে কবিতা ও প্রবন্ধে নিজস্ব স্বাক্ষর রেখেছেন।

’অগ্রণী’ (১৯৭৩) সম্পাদক তপন সেন। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী। মেধাবী ছাত্র। ইউনিয়নের ঘরণায় তপনের নিজস্ব কাগজ। এক ফর্মার কাগজ। নিউজ প্রিন্টে ছাপা; সালমা প্রিন্টিং ওয়ার্কস, নিউ মার্কেট শেরপুর থেকে। সস্পাদক লিখেছেন, “আমাদের চেতনার দৃঢ়তায় যে সন্মিলন মুক্তির, সমাজতন্ত্রের এবং দেশকে গড়ে তোলার— সেই মহতী আদর্শকে বাস্তবায়নের বজ্র শপথ নিয়ে সংগ্রামী ছাত্র সমাজ এবং দেশবাসীকে ঐক্যের আহ্বান জানাচ্ছি।” নববর্ষ উপলক্ষ্যে প্রকাশিত অগ্রণীতে লিখেছেন, আব্দুর রশিদ খান, খন্দকার আবুল কাশেম, নূরল ইসলাম হিরু, সুফিয়া খাতুন ও দুলাল দে বিপ্লব।

আমার সবুজ আত্মা ভাগ হয়ে যায়
মানচিত্রে অনেক রক্ত
ছোপ ছোপ
মাতৃ হত্যার নিষ্ঠুর মহড়ায়
          (আমার সবুজ আত্মাঃ তপন সেন)

শেরপুর ছোটকাগজ চর্চা – পর্ব ৩

১৯৭০ সালের প্রথম দিকে তরুণ কবিদের নিয়ে গঠিত হয় ‘কন্ঠস্বর সাহিত্য পরিষদ’। বামধারার সাহিত্য কর্মীদের নিয়ে গোলাম রহমান রতনের নেতৃত্বে গঠিত হয় এই সাহিত্য পরিষদ। এই পরিষদের মুখপত্র ’অঙ্গন’ প্রকাশিত হয় ডিসেম্বরে গোলাম রহমান রতন ও উদয় শংকরের যৌথ সম্পাদনায়। প্রচ্ছদ করেন কবি রণজিত নিয়োগী। বিনিময় মূল্য পঁচিশ পয়সা।

গত শতকের সাতের দশকে শেরপুরে সাহিত্য চর্চা প্রসঙ্গে সম্পাদক লিখেছেন, “….. যখন আচমকা বাতাস এসে সমুদ্রের বেলাভুমিতে আছড়ে পড়েছে তখন ছিটাফোঁটা সমুদ্রের লোনা জল এসে ক্ষণিকের জন্য বেলাভূমিকে দিয়েছে প্লাবিত করে কিন্তু সমুদ্র যখন নিস্তরঙ্গ তখন আর বেলাভুমিতে স্নাত করতে পারিনি।—- শুকিয়ে গেছে— ঠিক তেমনি আমাদের স্থানীয় সাহিত্য অঙ্গন।”

কিশোর কবি সুকান্ত স্মরণে গোলাম রহমান রতন লিখেছেন ’চমৎকার আখ্যান’; তেমনি উদয় শংকর রতনের গল্পটি সুখপাঠ্য। রবীন্দ্র কাব্যে ’নারী’ নিবন্ধ লিখেছেন দুলাল চন্দ্র দে। এই তিনজনই শেরপুরে সাহিত্য চর্চায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। পত্রিকা প্রকাশ কিংবা সংগঠন চর্চা– উদ্দমী এই তিন তরুণ গত শতাব্দীর সাতের দশকে প্রাগ্রসর তরুণ। পরবর্তীতে কোন লেখক তাদের সাহিত্য কর্ম নিয়ে পর্যালোচনায় এগিয়ে আসেন নি। স্থানিক সাহিত্য চর্চার চাতাল নির্মাণে তাদের ভূমিকা অসধারণ। ‘অঙ্গন’ একটি স্বকীয় বৈশিষ্ঠ্যময় পত্রিকা। মাত্র দুটো সংখ্যা প্রকাশিত হয়েছে।

একটি স্বাধীনতার পূর্বে এবং পরবর্তী সংখ্যা প্রকাশিত হয় স্বাধীনতার পরে। পরের সংখ্যার সহ সম্পাদক ছিলেন দুলাল দে বিপ্লব। এছাড়াও এই পরিষদ থেকে ‘ঘোষনায় আমরা’ এবং ’নন্দিত নবীন’ নামে দুটি সাহিত্য পত্রিকা অনিয়মিত সংখ্যা হিসেবে বের হয়। তবে অঙ্গন যেভাবে সজ্জিত হয়ে ওঠেছিল সেভাবে ঘোষনায় আমরা ও নন্দিত নবীন সাজতে পারেনি। আর অঙ্গনও বিকশিত হতে পারেনি।

সংখ্যা গুলোতে আরো লিখছেন জিতেন সেন নুরুল ইসলাম হিরু, মোজাম্মেল হক, প্রণব দে, মুশতাক হাবিব শাহেদা বেগদ, শিবানী দে।

 পিকাসোর ছবির মতোন
একটা ষাঁড় একটা ঘোড়া
মুখোমুখি উদ্যত;
এ ওকে ধরছে
ও একে ধরছে
ঘোড়াটা বাঁচাতে চেয়ে
মুখোমুখি ময়ুর পাশে দাঁড়িয়ে।
আর্ত চিৎকার
আর্ত চিৎকার
মেয়েদের মায়েদের শিশুদের
শুধু চিৎকার।
ষাঁড়টা ফুঁসছে ক্রুদ্ধ গর্জনে।
নিরবতার মধ্যবিত্ততাকে সাক্ষী রেখে
একটা কাণ্ড ঘটে গেল।
            (স্কেচ: গোলাম রহমান রতন)

 ১৯৭৪ সালে ‘কণ্ঠস্বর সাহিত্য পরিষদ’ এর সর্বশেষ অনিয়মিত সংখ্যা ’ঘোষনায় আমরা’ প্রকাশিত হয়। এটি ছিল চতুর্থ সংখ্যা।

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা- পর্ব ৪

গত শতাব্দীর ছয়েক দশক বাঙালী জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ে পরিচিত হবার দশক। স্বাধীকার অর্জনে ব্যক্তি ও সমাজের আলোড়িত হবার দশক। ষাটের তরুণ জাতীয়তাবাদী বা মার্ক্সবাদী হওয়া ছাড়া তার অন্য কোন পথ ছিল না। সময়ের আহ্বান–সময়ের বাধ্যবাধকতা তরুণকে ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছে। শেরপুরের যুব সমাজ তার ব্যতিক্রম নয়।

গোলাম রহমান রতন লিখেছেন, “প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক চর্চা বজায় রাখতে গিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলনও করেছি। ষাটের দশকে শেরপুরে সংস্কৃতি চর্চা বলে কিছু ছিল না বললে অত্যুক্তি হবে না। সংস্কৃতিতে ছিল পুরো বন্ধ্যাত্ব।” এমনিতেই দেশভাগ জনিত প্রতিক্রিয়ায় দেশ জুড়ে ছিল অস্থিরতা অন্যদিকে বাঙালী জনগোষ্ঠীর নিজস্বতা অর্জনের জন্য ছিল নানা রাজনৈতিক তৎপরতা।

ষাটের দশকে শেরপুরে ছিল ’পূর্ব পাকিস্তান আর্ট কাউন্সিল’ নামে সরকারি পর্যায়ের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। মুহম্মদ আখতারুজ্জামান ‘হৃদয়ে হীরা কাকা’ স্মৃতিকথায় লিখেছেন, “সেই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সংস্কৃতি তথা অধিকাংশ ক্ষেত্রে মৌলবাদভিত্তিক এবং ধর্মীয় সংস্কৃতি তুলে ধরা হতো।”

ষাটের তরুণ ইমদাদুল হক হীরা (১৯৩৪-২০০৭) বাঙালী সংস্কৃতির ধারাকে জনগনের মাঝে ছড়িয়ে দিতে গড়ে তোলেন ‘গণসংস্কৃতি সংসদ’। মূলত আর্ট কাউন্সিলের নানা তৎপরতার প্রতিক্রিয়ায় প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী তরুণেরা ইমদাদুল হক হীরার নেতৃত্বে। গঠন করলেন গণসংস্কৃতি সংসদ।

আক্তারুজ্জামান লিখেছেন, “হীরা কাকার বাসায় প্রথম যে মিটিং হয়, সেখানেই জন্ম হয় এই গণসংস্কৃতি সংসদ” সময় ১৯৬৮ সাল। উপস্থিত ছিলেন শাহেদা বেগম রুনু, সৈয়দ আব্দুল হান্নান, আবুল কাশেম আব্দুর রশিদ, লুৎফর রহমান মোহন, গোলাম রহমান রতন, আমজাদ হোসেন, মুহসীন আলী, সুরঞ্জিত সাহা, নিতাই হোড় নারায়ন হোড়, রণজিত হোড়, তপতী হোড়, জয়শ্রী নাগ, সাহিদা বেগম, পরিতোষ পাল, বিজন কর্মকার সুষেণ মিত্র মজুমদার তৃপ্তি দে, চিত্রা মিত্র মুক্তি, আলো চায়না, চম্পা প্রমুখ।

গণসংস্কৃতি সংসদের কোন মুখপত্র ছিল না। সংসদের হাতিয়ার ছিল নাটক। সঙ্গীত। নৃত্য। শেরপুরে সাংস্কৃতিক চর্চার জমিন বিনির্মাণে সংসদের তৎপরতা উল্লেখযোগ্য। সংসদের সভপতি ছিলেন সৈয়দ আবদুল  হান্নান ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এমাদদুল হক হীরা।  সর্বতো ভাবে প্রগতিশীল ও গণমুখী সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাই ছিল গণসংস্কৃতি সংসদের উদ্দেশ ও লক্ষ্য” লিখেছেন শেখ আবদুল জলিল। উনসত্তুর সালের উত্তাল বাংরাদেশ। জলিল বলেন, “উত্তাল জনগণের মন ও জীবন প্রতিবাদমুখর। সে সময়ে যা কিছু পাকিস্তানী তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের  ডাক দিয়েছিল গণসংস্কৃতি সংসদ।”

শেরপুরে নাটক চর্চার ইতিহাস বহ পুরানো। নয়ানী জমিদারদের নাট্যপ্রীতি সকলেই জানেন। কেউ এক জন হয়তো সেই ইতিহাসের তত্ত্বতালাশ করবেন। তবে এখানে বলে রাখি এই সংসদ থেকেই প্রথম শেরপুরে ছেলে মেয়েরা একসাথে নাটকে অভিনয় করা শুরু করেন।সংসদ ছিল নাটক প্রধান সংগঠন।

ছেলে মেয়েদের যৌথ অভিনয়নের মাধ্যমে ’প্রবেশ নিষেধ’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এ ছাড়াও ধনঞ্জয় বৈরাগীর ‘রূপালী চাঁদ’ আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে,’ ‘সংবাদ কার্টুন’ আলাউদ্দিন আল আজদের ‘সংবাদ শেষাংশ’নাটক মঞ্চস্থ হয়।

মূলত মার্ক্সবাদী তরুণেরাই গড়ে তুলে গণসংস্কৃতি সংসদ। সেই আলোকেই সংসদ পরিচালিত হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর জাতীয়তাবাদী তরুণেরা সংসদ থেকে বের হয়ে গড়ে তুলে ‘কৃষ্টি প্রবাহ’ গোষ্ঠি। বঙ্গাব্দ ১৩৭৭ (১৯৭০) সালে কৃষ্টি প্রবাহের যাত্রা শুরু।

মুহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, “আদর্শিকতার কারণেই কৃষ্টি প্রবাহের জন্ম। ডা: আহমেদুর রহমানের বাসায় গণসংস্কৃতি সংসদের সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন থেকে গণসংস্কৃতি সংসদ ভেঙে কৃষ্টি প্রবাহ সৃষ্টি হয়।” মুহম্মদ মুহসীন আলী সভপতি ও নারায়ন চন্দ্র হোড়কে সাধারণ সম্পাদক করে প্রবাহের যাত্রা শুরু হয়।

যদিও ছিয়াত্তর সালে কিছু তরুণ কৃষ্টি প্রবাহ থেকে বের হয়ে গঠন করলেন ‘ত্রিসপ্তক’ দীলিপ পোদ্দারের নেতৃত্ব। আরো যুক্ত হলেন অভিনেতা দেবদাস চন্দ, তবলাবাদক উদয় সাহা, নর্তক কমল পাল। গোলাম রহমান রতন লিখেছেন, “নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে কতিপয় তরুণের প্রচেষ্টায় ‘ত্রিসপ্তক গোষ্টি’ গঠিত হয়েছে। পপ সঙ্গীতের নতুন জগতে এদের প্রবণতা লক্ষনীয়।” তবে ওস্তাদ কানুসেন গুপ্ত কৃষ্টি প্রবাহে প্রশিক্ষক হিসেবে থেকে গেলেন। পরবর্তী কালে এই তরুণেরা শেরপুরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবাণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছে।

’কৃষ্টি প্রবাহ’ একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। গান নৃত্য বাঁশি তবলা শেখার প্রতিষ্ঠান। শেরপুরে নাট্যানুষ্ঠান, প্রীতি সন্মীলনী জয়ন্তী উৎসব ছাড়াও বিভিন্ন দিবস কেন্দ্রিক পত্রিকা প্রকাশ করেছে। এমনকি  ময়মনসিংহে ব্রহ্মপুত্র নদ খননের স্বেচ্ছাশ্রম ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষপীড়িত অঞ্চলে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে কৃষ্টি প্রবাহ। কৃষ্টি প্রবাহের অভিনীত নাটকগুলো হলো: মেঘে ঢাকা তারা, লবণাক্ত, সকালের জন্য, জীবন রঙ্গ, ফাঁস ও নিষ্কৃতি।

সাতের দশকে কৃষ্টিপ্রবাহ সাংস্কৃতিক চর্চায় টাউন শেরপুরে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। দেশভাগের কারণে অনেক সাংস্কৃতিক কর্মী দেশত্যাগের কারনে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যে ভাঁটা পড়েছিল কৃষ্টি প্রবাহের নানামুখী কায়কারের টাউন শেরপুরে আবারো সাংস্কৃতিক চর্চার জোয়ার আসে। কৃষ্টি প্রবাহ একটি প্রাতিষ্ঠানিক সংগীত শিক্ষার প্লাটফর্ম। সেখানে নাচ গান অভিনয় তবলা বাজানো থেকে শুরু করে বাঁশী শেখানোর কার্যক্রম ছিল।

১৯৭৪ সালে কৃষ্টি প্রবাহ প্রকাশ করে ‘শহীদ স্মরণিকা’ বুলেটিন। সম্পাদক সুশীল মালাকার। সম্পাদক সুশীল লিখেছেন, “একটা জাতির ঐশ্বর্য প্রতিভাত হয় ভাষার মাধ্যমে। বাঙালী জাতির প্রধান সম্পদ হচ্ছে তার মুখের ভাষা; প্রাণের ভাষা — বাংলা ভাষা। এই ভাষাতেই সে ঐশ্বর্যবান। কিন্তু সেই ঐশ্বর্যবানের সংখ্যা কত?” সম্পাদক সুশীলের একটি মৌলিক প্রশ্ন যা আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।

১৯৫২ থেকে ২০২০। অনেক বছর পেরিয়ে এসেছি আমরা। বাংলা ভাষার ঐশ্বর্যে অবগাহন করতে পারিনি। পারিনি ভাষা মুক্কির চেতনায় ঋদ্ধ হতে। প্রভাত ফেরিতে যাচ্ছি কালো ব্যাজ ধারন করছি। পারিনি বুঝতে যে ভাষামুক্তি কথাটা শুধু মাত্র বাংলা ভাষা প্রশ্নে সীমাবদ্ধ নয় বরং সকল ভাষার জন্য সমান সত্য।

যে বাংলা ভাষাভাষী মানুষ একদিন নিপীড়নের শিকার সেই ভাষাভাষী মানুষেরা আজ অন্যন্যা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ভাষার উপর আধিপত্য জারি রেখেছি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠির ভাষা এখন সংকটাপন্ন। এটা একুশের চেতনা নয়। হারিয়ে যাচ্ছে বহু ভাষা। বহুভাষা সংস্পর্সে জীবন পায় বহরৈখিকতার স্বাদ। একুশের চেতনা সকল ভাষার বিকাশের চেতনা। একুশের চেতনা সকল ধরনের আধিপত্য বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার শক্তি।

কৃষ্টি প্রবাহের মুখপত্র প্রবাহ অনিয়মিত দিবস ভিত্তিক পত্রিকা। ১৯৭৪ সালের শহীদ সংখ্যা বুলেটিনে সুনীল বরন দে’ তার ‘শেরপুরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার’ নিবন্ধে লিখেছেন, “পাকিস্তানী অটোক্রেসির বিরুদ্ধে যুগের যন্ত্রণার সঙ্গে সঙ্গে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য যখন আত্ম স্বাতন্ত্র্য চেতনায় রূপ নিলো তখনই বাংলা সংস্কৃকিতে বিপ্লবের সূচনা হলো।

‘অনেক অন্ধকারকে বুকে তুলে নিয়ে
সূর্যের আলোকে
তোমাকে অনেক খুজেছি
ব্যর্থতার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
জীবনে কি পাইনি— কি পেয়েছি?”
             (মুক্তির আলোকে তোমাকে/ উদয় শংকর রতন)

সম্পাদক সুশীল ‘প্রবাহ’ ছাড়াও স্বাধনীতার পূর্বে ‘দখিনা’ নামে আরেকটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সুশীল মালাকার লিখেছেন, “১৯৬৭ সালে আমি ও মোজামেল হকের যৌথতায় ‘দখিনা’ নামে নিউ প্রেস থেকে একটি মাসিক পত্রিকা বের হয়। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে পত্রিকাটির একটি মাত্র সংখ্যা প্রকাশিত হবার পরই বন্ধ হয়ে যায়।” সুশীল মালাকার রাজনৈতিক কারণটি কী তা তিনি  ব্যাখ্যা করেননি। করলে হয়তো বোঝ যেতো মফস্বলে সাহিত্য পত্রিকা করার প্রতিবন্ধকতার মাত্রার ধরন ধারন।

‘দখিনা’ ছাড়া সুশীল কিশোর বয়সে আরো একটা পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন। তিনি আরো জানাচ্ছেন, “১৯৫৭-৫৮ সালে আমি ও অধীর চন্দ্র দাসের সম্পাদনায় ও আবুল কাশেমের সহযোগিতায় “কিশোর” নামে হাতে লেখা একটি পাক্ষিক পত্রিকা কিছুদিন প্রকাশিত হয়েছিল।”

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা- পর্ব ৫

১৯৪৭ সালের পূর্বের পঞ্চাশ বছর কোন সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে কিনা তার কোন দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। যদিও টাউন শেরপুরে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক চর্চা বিশেষ করে নাট্যচর্চা চর্চার ধারাবাহিক কার্যক্রম ছিল। পন্ডিত ফসিহুর রহমান ও অধ্যাপক দেলওয়ার হোসেন শেরপুরের ইতিহাস নিয়ে কাজ করলেও তাদের বইতে সাহিত্যপত্রিকা বিষয়ক কোন আলোচনা করেন নি।

উনিশ শতক থেকেই শেরপুরে সাহিত্যচর্চার জমিন তৈরি হতে থাকে। এ ক্ষেত্রে হরচন্দ্র চৌধুরীই (১৮৩৭–১৯১০) এ জেলায় সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে প্রথম পথিক। তিনি ছাড়াও পন্ডিত চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার (১৮৩৬–১৯১০), বিজয়কৃষ্ণ নাগ, রাধাবল্লভ চৌধুরী, রামকান্ত, রামনাথ বিদ্যাভূষণ, হরগোবিন্দ লস্কর, হরসুন্দর তর্করত্ন, নারী কবি হিরন্ময়ী চৌধুরী, পাইকুড়া গ্রামের অধিবাসী পুঁথিলেখক রমজান আলী, কবি ফজলুল রহমান আজনবী, আব্দুল কাদের মুন্সী, একই গ্রামের বিপ্লবী ও লেখক প্রমথ গুপ্ত, কবি কিশোরী মোহন চৌধিরী, মীরগঞ্জ অধিবাসী মুন্সী বছির উদ্দিন, শ্রীবর্দীর গোলাম মোহম্মদ এবং রৌহা গ্রামের অধিবাসী সৈয়দ আবদুস সুলতান শেরপুরের সাহিত্যচর্চার স্মরণীয় বরণীয় অগ্রসৈনিক।

তাঁদের সাহিত্যকৃত্য নিয়ে দুই ইতিহাস লেখক বিশেষ কিছু লিখেন নি। পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনালোকিতই থেকে গেছে। এতে করে শেরপুরকে জানবার বুঝবার ও ছড়িয়ে দেবার পথ হয়ে গেছে সংকীর্ণ। ”ময়মনসিংহ জেলার অন্তগর্ত একটি উপজাতি অধ্যুষিত জনপদে বিদ্যোৎসাহী কতিপয় জমিদারদের প্রচেষ্টায় যে বিকাশ শুরু হয়েছিল দুর্ভাগ্যক্রমে আধুনিক যুগে তা ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করতে পারেনি।”

দেশভাগ উত্তর দশ বছরে শেরপুরের কি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি? একদিকে দেশভাগ জনিত মানুষের অস্থিরতা; কেউ কেউ পাড়ি দিচ্ছে সীমান্তের ওপারে; পরিবার ভাঙছে—-অন্যদিকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের আবির্ভাব—  এই সামাজিক রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহ কি সেই সময়ের তরুণদের প্রভাবিত করে নি? তাছাড়া বায়ান্নেরর ভাষা আন্দোলনের বছর?

১৯৫২ সালে ভাষার প্রশ্নে লড়াই সংগ্রাম শেরপুরে রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল বলিষ্ঠ। সেই সময়ে কি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়নি? অনেক অনুসন্ধানে তথ্য পেলাম ‘সাপ্তাহিক পয়গাম’ সৈয়দ আবদুস সুলতান ১৯৫২ সালে প্রকাশ করেন। সৈয়দ সুলতান স্বাধীনতার পর বৃটেনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। এছাড়া দেশভাগ উত্তর সময়ে আর কোন সাহিত্য পত্রিকা হয়নি। কেন হয়নি তার কার্যকারণ কেউ হয়তো খুঁজবেন।

তবে এখানে একটু তথ্য যোগ করা যেতে পারে। দেশভাগের তিন বছর পর টংক প্রথাবিরোধী যে আন্দোলন ময়মনসিংহের উত্তরে শুরু হয়েছিল সেই আন্দোলনে শহীদ হন নালিতাবাড়ি কমিউনিস্ট নেতা কমরেড শচী রায়। ১৯৫০ সালের ১৬ মে। তিনি দেশভাগ উত্তর প্রথম শহীদ। তাঁর স্মরনে কমিউনিষ্ট পার্টি একটি বুলেটিন প্রকাশ করেন। নাম ছিল ‘রশ্মি’ শহীদ স্মরণে সাইক্লোস্টাইলে ছাপা রস্মিতে ছিল রাজনৈতিক প্রবন্ধ ও শচী রায় কে উৎসর্গ করে লেখা কবিতা।

১৮৬৯ সালের ১৬ জুন শেরপুর পৌরসভা ঘোষিত হবার চার বছর পূর্বে ‘বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ (১৮৬৫) নামে একটি মাসিক পত্রিকা যাত্রা শুরু করে জমিদার হরচন্দ্র রায় চৌধুরির প্রযত্নে চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কারে সম্পাদনায়।

উক্ত পত্রিকা প্রকাশের আগে  গঠিত হয় ‘বিদ্যোন্নতি সাহিত্য চক্র’। গোপা হেমাঙ্গী রায় তাঁর ‘সোনার খাঁচার দিনগুলি’ বইতে লিখেছেন, ”ঘনিষ্ঠ বন্ধু চন্দ্রকান্ত তর্কালংকার ও ঈশান চন্দ্র বিশ্বাসের উৎসাহে ও প্রেরণায় ১৮৬৫ সালে হরচন্দ্র নিজের বাড়িতে ’বিদ্যোন্নতি সভা’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন।” তখন শেরপুর তো দূরের কথা ময়মনসিংহে কোন প্রেস ছিল না। ছিল না কাছাকাছি ধনবাড়ি কিংবা টাংগাইল জমিদার শাসিত কোন অঞ্চলে।

’বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ ময়মনসিংহ জেলার প্রথম পত্রিকা। এই সভা থেকেই প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক চারুবার্তা’। তখনো পৌরসভা গঠিত হয় নি। যে বছর শেরপুরে পৌরসভা হয় সেই একই বছরে আট এপ্রিলে ময়মনসিংহ পৌরসভা গঠিত হয়। শেরপুর পৌরসভা ময়মনসিংহেরর চেয়ে কয়েক মাসের ছোট এবং প্রান্তিক পৌরসভা। নিশ্চয় সেই সময়ে শেরপুর অঞ্চল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ভাবে পরিগঠিত হবার সূচক বৃটিশের বার্ষিক রিপোর্টে উর্ধ্বমুখী ছিল।

১৮৮০ সালে ‘চারুপ্রেস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রেস থেকেই গিরিশ সেন কৃত পবিত্র কোরআন শরিফের বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হয়। “১৮৮১ সালের শেষ ভাগে আমি ময়মনসিংহে যাইয়া স্থিতি করি, সেখানে কোরান শরিফের কিয়দ্দূর অনুবাদ করিয়া প্রতিমাসে খণ্ডশঃ প্রকাশ করিবার জন্য সমুদ্যত হই। শেরপুরস্থ চারুযন্ত্রে প্রথম খণ্ড মুদ্রিত হয়…”৮

একই প্রেস থেকে ১৮৮৫ সালে মীর মোশারফের বিষাদ সিন্ধু ছাপা হয়। অন্যদিকে শেরপুরে যেহেতু জমিদারদের মাঝে শরিকী ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দ্বন্দ্ব যেমন ছিল, তেমনি ছিল কল্যাণমূলক কাজের প্রতিযোগিতা (ভিক্টোরিয়া স্কুল জিকে পাইলট স্কুল প্রতিষ্ঠা উল্লেখ্যা)।

নয় আনী জমিদারের পাশাপাশি পৌনে তিন আনী জমিদার প্রতিষ্ঠা করেন জগন্নাথ অগ্নিহোত্রির প্রযত্নে ‘শেরপুর বিজ্ঞাপনী প্রেস’ (১৮৯৫)। এই প্রেস থেকেই প্রকাশিত হয় ‘সাপ্তাহিক বিজ্ঞাপনী সংবাদ’। শেরপুরের জমিদারবৃন্দ শুধু মাত্র বাণিজ্যের জন্যই শুধু প্রেস স্থাপন করেন নি, তাদের ছিল সমাজ সংস্কৃতির প্রতি দায় বদ্ধতার জায়গা থেকে কল্যানমুলক কার্যক্রম চালানো পরিসর নির্মান করা।

এই প্রান্তিকে যে প্রেস ব্যবসা সুবিধে করতে পারবে না তার সম্যক জ্ঞান জমিদার কর্তা ব্যক্তিদের ভালই ছিল। জমিদার বিলাসী হলেও পাকা চুলের নায়েবদের লাভ ক্ষতির হিসাব ছিল নখের ডগায়। নয় আনী জমিদারের অধীনে ব্যবস্থাপকের চাকরি করতে আসা গীতিকবি গোবিন্দ দাসের কয়েক কাব্যগ্রন্থ এই চারু প্রেস থেকেই নয় আনী জমিদারের পৃষ্টপোষকতাই প্রকাশিত হয়। নিয়মিত বিদ্যাোন্নতি সাধিনী প্রকাশিতও হচ্ছে এই প্রেস থেকে। হরচন্দ্রের ‘সেরপুর বিবরণ’ গ্রন্থের অধিকাংশ রচনা এই কাগজেই প্রথম প্রকাশিত হয়।

বছর ভিত্তিক তথ্য উপাত্ত হরচন্দ্র চৌধুরী প্রণিত ‘সেরপুর বিবরণ’ গ্রন্থ হতে প্রাপ্ত। শেরপুরের সুধীমহল ও পরবর্তীতে যারা ইতিহাস নিয়ে কাজ করেছেন তারাও সেরপুর বিবরণ (১৮৭৩) ও নাগবংশের ইতিবৃত্ত (১৯৩০) হতে প্রাপ্ত সন তারিখ লিখেই ইতিহাস রচনা সমাপ্ত করেছেন। কোন ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেননি।তথ্য হিসেবে হাজির আছে শুধু।

তৎকালীন সময় ও তার কার্যকারণে কী ঘটেছে কোন আর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই শেরপুর পল্লবিত হয়ে উঠল এবং কেনই বা পরবর্তী পঞ্চাশ ষাট বছর নিষ্ফলা মাঠের মতো পড়ে রইল তার বিশ্লেষণ করা হয়নি।

শেরপুরের সাহিত্য বিষয়ক আলোচনা
জ্যোতি পোদ্দার: দেশভাগ উত্তর শেরপুরের সাহিত্য বিষয় আলোচনা।

শেরপুর পরিগঠনে হরচন্দ্র চৌধুরীর যে ভূমিকা তার কোন মূল্যায়ন শেরপুরের ইতিহাস প্রণেতারা করেননি। নাগরিক সমাজও মনে রাখেননি এই বহুভাষায় দক্ষ পণ্ডিত মানুষকে। অধ্যাপক দেলওয়ারের ‘শেরপুরের ইতিকথা’ (১৯৬৯) পণ্ডিত ফসিহুর রহমানের ‘শেরপুর জেলার অতীত ও বর্তমান’ (১৯৯০)— এই দু’টি বইয়েই পরবর্তী অনেক তথ্য উপাত্ত তারা  যুক্ত করেছেন। এ জন্য তারা আমাদের নমস্য। আগামী কালের কোন ইতিহাসবেত্তা নিশ্চয় এই বইগুলো থেকে রসদ যেমন পাবেন তেমনি পাবেন সামাজিক সাংস্কৃতিক অর্থনৈতিক তথা রাজনৈতিকতার ঘটনা প্রবাহ ও তার কার্যকারণ এবং মিসিংলিংক।

একমাত্র নালিতাবাড়ির অধ্যাপক মোস্তফা কামাল হরচন্দ্র চৌধুরী ও তাঁর সেরপুর বিবরণ সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে বলেছেন, “তাঁর বইটি শুধু মাত্র একটি তথ্য প্রদান ও গবেষণামূলক ঐতিহাসিক গ্রন্থই নয়—- বিপ্লব, বিদ্রোহ অভুত্থান ও জীবন চেতনা এবং বাস্তব সমাজ চেতনার এককালের সাক্ষী। সবচেয়ে শিল্পী হরচন্দ্র চৌধুরীর প্রতি আমাদের মস্তক শ্রদ্ধায় অবনত হয় এ জন্যই যে, সামন্ত জমিদার হরচন্দ্রেরা শ্রেনীস্বার্থ রক্ষার জন্য কৃষক সংগ্রামকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে চেয়েছে— এই সামন্ত হরচন্দ্রই শেরপুরের কৃষক অভুত্থানের সংগ্রামী ও বৈপ্লবিক চেতনার জয় ঘোষনায় মুখরিত। অন্তরের সমস্ত সত্তাটুকু নিঙড়িয়ে দিয়ে তিনি কৃষকদের সংগ্রামী চেতনাকে চিত্রিত করেছেন এবং আসল সত্য ও তথ্যের দিক নির্দশের করেছেন। শিল্পী হরচন্দ্র চৌধুরী এখানে কৃষকদের সংগ্রামকে লক্ষ্যে পৌছিয়ে দেবার জন্য একাত্ম। এখানে শিল্লী হরচন্দ্র চৌধুরী সামন্ত হরচন্দ্রকে পরাজিত করে স্বাধীন শৈল্পিক সত্তায় জাগ্রত ও স্পষ্টবাক।”

স্থানিক ইতিহাসের ভিত্তি যে প্রাতস্মরনীয় মানুষদের হাতে নির্মিত হয়েছে তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েই এগুতে হবে সামনের পথ। আরো প্রয়োজন পর্যালোচনা। স্থানিক ইতিহাসের রসদ রচনা ছাড়া জাতীয় ইতিহাস বিকাশ হতে পারে না। একটি শক্তিশালী জনগোষ্ঠি গঠনে স্থানিক ইতিহাস বিনির্মান ছাড়া হতে পারে না।

পূর্বের অংশ: শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা

রেফারেন্স: শেষ পর্বে।

Leave a Reply

Scroll to Top