একুশে ফেব্রুয়ারি ও আমাদের প্রত্যাশা, ক্যাপ্টন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম

লেখকঃ ক্যাপ্টন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম, সেনা শিক্ষা কোর।

১৯৪৮ সালে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে প্রথম যে আন্দোলন শুরু হয় তা ১৯৫২ সালে এসে মহিরুহ রূপ ধারণ করে।সরকার সে বছর ২১শে ফেব্রুয়ারিতে ছাত্র জনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করে অসংখ্য ছাত্র জনতা হত্যা করলে সারাদেশে আন্দোলন বারুদ গতিতে ছড়িয়ে পরে। অবশেষে বাধ্য হয়ে পাকিস্তান সরকার উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। ৫২ সালের রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন আমাদের প্রথম সফল আন্দোলন। এ বিজয় বাঙালিদের সাহসী করে তোলে। ফলে ৫৪ এর নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। তারই ধারাবাহিকতায় ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, ৬৬ এর ছয় দফা, ৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ৭০ এর নির্বাচন সর্বোপরি ৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে আমরা জয়লাভ করি। একুশ আমাদের মহান স্বাধীনতা অর্জনের সূতিকাগার। একুশের শক্তি, সাহস ও প্রেরণায় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে “মহান স্বাধীনতা” অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

ভাষা আন্দোলনের পর অনেক বছর কেটে গেছে কিন্তু তার লক্ষ্য “সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন”এখনো সুদূর পরাহত। স্বাধীনতা অর্জনেরও অনেক বছর পার হলো কিন্তু এখনও আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি নাই। আমরা অনেকেই বিশেষকরে ডিগ্রিধারীরাও মাতৃভাষা শুদ্ধভাবে পড়তে, লিখতে ও বলতে পারিনা বা বলি না। এখনও উচ্চ আদালতে কিংবা উচ্চ শিক্ষায় বাংলা চালু করতে পারি নাই। দেশে প্রতিষ্ঠিত ইংরেজি মাধ্যম স্কুল, কলেজ ও এফএম ব্যান্ডের রেডিতে অদ্ভুত উচ্চারণ শুনলে কষ্ট না পেয়ে আর কোন উপায় থাকে না। তাদের “বাংলিশ” উচ্চারণ চলতে থাকলে একদিন আমাদের প্রমিত উচ্চারণই হারিয়ে যাবে নিঃসন্দেহে।

রাস্তাঘাটে চলার সময় বিলবোর্ড, সাইনবোর্ডের দিকে তাকালে দেখাযায় অধিকাংশগুলোই ইংরেজিতে। পাশাপাশি বাংলায় লেখা থাকলেও ভুল বানানে ভরপুর। এ-তো গেল লেখার চিত্র। আমাদের অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রীদের বাংলা পড়া, লেখা ও বলা শুনলে অবাক হতে হয়। সাথে আমাদের কিছু সম্মানিত শিক্ষকবৃন্দও ওদের কাতারে। ইদানীং টিভি নাটক বা সিনেমায় যে হারে আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার হচ্ছে, জানিনা আগামিতে প্রমিত বাংলা উচ্চারণ থাকবে কিনা।

আমাদের দেশে প্রায় ২১ রকমের আঞ্চলিক ভাষা আছে। নিশ্চয়ই সেগুলো ব্যবহৃত হবে, তবে ঢালাওভাবে নয়। আমরা যখন পারিবারিক পরিমন্ডলে থাকি তখন যেনতেন কাপড় চোপর পরিধান করি। যখন বাইরে বের হই তখন নিশ্চয়ই পরিপাটি হয়েই বের হই। কেউ কেউ মেকআপ নেই। তদ্রূপ আমরা পারিবারিক পরিমন্ডলে নিজস্ব ভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করবো, কিন্তু যখন স্কুল কলেজে বা সভা সমাবেশে বলবোতখন অবশ্যই প্রমিত উচ্চারণ করবো। যখন লিখবো শুদ্ধ বানানেই লিখবো।

এটা শুরু হতে হবে প্রাক প্রাথমিক স্তর থেকেই। যখন ছেলেমেয়েদের বর্ণমালা শেখানো হয় তখন থেকেই শুদ্ধভাবে শেখাতে হবে। তাই শিক্ষকদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রথমে তাঁরা আগে তৈরী হবেন, তারপর শিক্ষাদান করবেন। আমাদের স্কুল কলেজ গুলোতে নিয়মিতভাবে আবৃত্তি, গান ও বই পড়ার প্রতিযোগিতা করতে হবে। অনুষ্ঠান শেষে একজন শিক্ষক তা গঠনমূলক সমালোচনার মাধ্যমে ভুলগুলো শুধরে দিবেন। তবেই ধীরে ধীরে ছেলেমেয়েদের মাঝে শুদ্ধ ভাষা চর্চার অভ্যাস গড়ে উঠবে। আর রাস্তা ঘাটের ও দোকান পাটের বিলবোর্ড গুলো প্রশাসনের মাধ্যমে শুদ্ধ বাংলায় লেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আদালত ও উচ্চ শিক্ষায় ধীরে ধীরে বাংলা চালু করতে সরকারকে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

আসুন, আজকের এ মহান একুশে দিবসে শুদ্ধ বাংলা চর্চার শপথ নেই এবং যার যার জায়গা থেকে শুদ্ধভাবে বাংলা লেখা, পড়া ও বলার অভ্যাস গড়ে তুলি। তবেই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন স্বার্থক হবে এবং ভাষা শহীদ ও ভাষাসৈনিকদের আত্মা শান্তি পাবে। আমারা ও আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম শুদ্ধভাবে বাংলা বলে, পড়ে ও লিখে গর্ববোধ করবো।

Leave a Reply