Our Sherpur

ইতিহাস কাঁপানো ‘গড় জরিপা দূর্গ’ এখন শুধুই স্মৃতি…

গড় জরিপা দূর্গ

রফিক মজিদ
কবি ও সাংবাদিক: রফিক মজিদ

ইতিহাসের বহু ঘটনার স্বাক্ষী ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুর জেলার গড় জরিপার বা গড় দলিপা আজ থেকে প্রায় ৫শ বছর আগে কামরুপ থেকে আসা কোচ রাজা দলিপ সামন্তের মাটিদুর্গ এখন ধ্বংস হয়ে গেছে। আধিপত্য পোক্ত করার জন্যে দলীপ সামন্ত গড় দলীপা দূর্গ নির্মাণ করেন। তবে মাটির দুর্গে ৪টি জাঙ্গালের জাঙ্গাল বা পরিখা মধ্যে ১টির এখনো অস্তিত্ব রয়েছে।

কিছু কিছু ইতিহাস আছে যুগ যুগ এবং শত শত বছর ধরে এর স্মৃতি সংরক্ষিত হয়ে থাকে। আবার কিছু কিছু ইতিহাস আছে এক সময় সব স্মৃতি মুছে গিয়ে কেবলি ইতিহাস হয়ে থাকে বইয়ের পাতায়। তেমনি একটি ইতিহাস শেরপুরের ‘গড় জরিপা দূর্গ’ বা স্থানীয় ভাষায় ‘জাঙ্গাল’ বা পরিখা। এ দূর্গের ইতিহাস পড়ে কেউ যদি এর সর্বশেষ ধ্বংসাবশেষের কাছে যায়, তবে হয়তো তিনি এ ইতিহাসকে কাল্পনিক বলে আখ্যায়িত করবে।

Products list of Our Sherpur
শেরপুর জেলার যেসব পণ্য আওয়ার শেরপুর এ পাওয়া যায়।

কারণ, ধ্বংসাবশেষের শেষ চিহৃত অবশিষ্ট ওই দূর্গের প্রায় ৪০ ফুট উচু পরিখাটি এখন ১০ ফুটের বেশী উচ্চতা নেই। বেশীর ভাগ টিলায় গড়ে উঠেছে বাড়ি-ঘর, কাঠ বাগান ও ফসলের মাঠ। দীর্ঘ ৫ শত বছরের ইতিহাস বলে স্থানীয়দের কাছে এ দূর্গের কোন মূল্য নেই। অনেকেই এটি এখন চিনতেও চায় না। তবে যারা এর অতিত ইতিহাস বাপ-দাদাদের কাছ থেকে শুনে বিশ্বাস করেছে তারা কিছুটা ওই দূর্গের ইতিহাস জানে।

দূর্গের উত্তর-পূর্ব প্রান্তের বর্তমানে বসবাস করেন কৃষক আ. খালেক। তিনি তার বাপ-দাদার কাছ থেকে শুনে আমাদের জানায়, এ দূর্গটিতে যখন বসতি স্থাপন শুরু হয়, তখন এর উচ্চতা এতটাই ছিল যে, মই দিয়ে বাড়িতে উফতে হতো। এছাড়া তিনি আরো জানায়, জাঙ্গালের (দৃর্গ) উত্তর-পূর্ব পাশের যে গেইটটি ছিল এখানের মাটি প্রায় সমতল হয়ে গেছে। কিন্তু এখানে এক সময় মাটি খুড়তে গেলে বিশাল আকৃতির পাথর বের হতো। কিন্তু সে পাথর কেউ বাড়িতে নিয়ে রাখতে পারতো না। অজ্ঞাত কারনে পরের দিন পাথরটি ওই স্থানেই রেখে আসতে হতো। কেউ কেউ বলেন, কোন ব্যাক্তি জাঙ্গালের পাথর বাড়িতে নিয়ে গেলে, ওই রাতেই তিনি স্বপ্ন দেখতো এবং পরের দিন ভোরে সেই পাথর সেখানেই ফেরে রেখে আসতো।

গড় জরিপার দূর্গ
বারো দুয়ারী মসজিদ

ইতিহাস সূত্রে জানা গেছে, ১৪৫০ খ্রিষ্টাব্দের দিকে বৃহত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর অঞ্চলে দলিপা নামক একজন কোচ রাজা রাজত্ব করতেন। উত্তরের গারো পাহাড়ের কড়ই বাড়ি, খুটিমারী, বার হাজারী হইতে দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদ এবং পূর্বে নেতাই নদী হইতে পশ্চিমে ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তাঁর রাজত্ব বিস্তৃত ছিল। তাঁর রাজধানী ছিল গড় জরিপা। দিলীপ সামন্ত বা দিলীপ সিংহের শেরপুর অধিকার ও রাজত্বকাল নিয়ে বিভিন্ন রকম তথ্য পাওয়া যায়।

শেরপুর জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার উত্তরে ভগ্ন গড় জরিপার দূর্গ। এই দূর্গে নকশার বিশেষ কাজ না থাকলেও ঐতিহাসিক বিবেচনায় এবং আকারের কারণে এর বিশেষ স্থান রয়েছে। তিনটি প্রাচীর দ্বারা বেষ্টিত ছিল। বাইরের প্রাচীর ও মাঝখানের প্রাচীরের মধ্যে ছিলো পরিখা। চারদিকে চারটি প্রবেশ পথ। এগুলোরো আবার ভিন্ন ভিন্ন নাম রয়েছে। পূর্বদরজা কাম দুয়ারী, পশ্চিমদরজা পানি দুয়ারী, দক্ষিণদরজা শ্যামশেখর দুয়ারী, উত্তরদরজা খিরদুয়ারী।

জানা যায়, সম্রাট আকবরের সময় এ অঞ্চলের নাম ‘দশ কাহনীয়া বাজু বলে’ ইতিহাসে পাওয়া যায়। তবে এ অঞ্চলের কোচ শাসক দলিপ সামন্তের রাজ্যের রাজধানী গড় জরিপার উল্লোখ আছে। দলিপ সামন্তের নাম থেকেই এর নাম হয় গড় দলিপা, তবে কালক্রমে বিকৃত হয়ে এই নাম গড়জরিপায় রুপান্তরিত হয়।

১৪৯১ খ্রিস্টাব্দে ফিরোজ শাহ স্বাধীন বাংলার নবাব হলে সেনাপতি মজলিশ শাহ হুমায়ন এটি অধিকার করেন। ঐতিহাসিক তথ্য অনুযায়ী ১৫১৯ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে শেরপুর অঞ্চল স্থায়ীভাবে বাংলার স্বাধীন পাঠান সুলতানদের অধিকারে আসে। মজলিস খান হুমায়ন শাহ চতুর্দশ শতাব্দীতে গড়জরিপাকে পথচারীদের জানমাল পাহাড়িয়া দস্যূ ও ঠগদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য একটি বিরাট দূর্গ ব্যবহারের অনুমতি দেন।

১৮৫৭ সালের প্রলয়ংকরী ভূমিকম্পে অনেক কিছুই ভেঙ্গে চূর্ণ হয়ে যায়। পরিখাগুলো সব সময় পানিতে পূর্ণ হয়ে খাল বা লেকের মত দেখাত। এর মধ্যে আবার নৌকা আকৃতির একটা দ্বীপ রয়েছে। ভূমিকম্পের পর আর দ্বীপটির অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। দূর্গের ভেতরে বেশকিছু দিঘী ছিলো সম্ভবত সৈন্য ও হাতি ঘোড়াদের গোসল এবং প্রয়োজনীয় জলের সংকুলান করার জন্য দিঘীগুলো খনন করা হয়েছিল। কালের পরিক্রমায় দিঘীগুলোও ভরাট হয়ে চলেছে। এর মধ্যে মতি মিয়ার তালাও নামে একটি জলাধার ছিলো। পরবর্তীকালে ওই বিরাট দুর্গ এলাকা এখন কৃষিক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে। কিন্ত এখনও দুর্গ প্রাচীর ও দুর্গ পরিখার কিছু কিছু চিহ্ন বর্তমান আছে।

ভেতরের প্রাচীরের মধ্যে ১.১৭০ বিঘা জমি। প্রাচীরের উচ্চতা ২৫ ফুট থেকে ৪৩ ফুট পর্যন্ত। প্রাচীরের পরিধি প্রায় ৫ কিলোমিটার। পরিখাগুলো ৪৫০ ফুট থেকে ৯০০ ফুট পর্যন্ত চওড়া।

জনশ্রুতিতে জানা যায়, আজ থেকে প্রায় ৫শ বছর আগে দিলীপ নামে একজন বনিক সর্দার এখানে বসতি স্থাপন করেন। তিনি গারো ও অন্যান্য আক্রমণকারীদের থেকে রক্ষার জন্য দূর্গ ও পরিখা নির্মাণ করেন। ফিরোজ শাহের রাজত্বকালে (১৫৫১-৮৭) এই সময়ের মধ্যে মজলিশ শাহ নামক এক সেনাপতি দূর্গ আক্রমণ করেন।

দিলীপ সামন্তকে হত্যা করে দূর্গ দখল করেন। দূর্গে এখন মজলিস শাহ হুমায়ন এর সমাধি এবং শিলালিপি থেকে ছিলো। পরে আরবি ও ফার্সী শিলালিপি থেকে এর পাঠোদ্বার করা হয়। তাতে লিখা ছিলো ‘‘পরম করুনাময় আল্লাহর নামে শুরু করছি (বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম) আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই, মুহাম্মদ (স) আল্লাহর রাসুল। (লা ইলাহা ইল্লালাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ)। আল্লাহর মনোনীত (হযরত) আলী (রা) পবিত্র হৃদয় (হযরত) ফাতিমা (রা) তাদের সন্তান এবং (হযরত) হাসান (রা), (হযরত) হোসেন (রা) এবং এ যুগের বাদশাহ শেইফল দুনিজা ওয়াদ্দিন আবদুল ফিরোজ শাহের আদেশে নির্মিত। মহান আল্লাহর ইচ্ছায় তার রাজ্য ও রাজত্ব চিরস্থায়ী হোক। পবিত্র রমযান মাসের অস্টম তিথিতে ইহা নির্মাণ করা হয়।

১৫৭৬ সালে কুচবিহারের রাজা লক্ষী নারায়ন এর সাথে তার গদি প্রত্যাশী পটকানোয়ারের বিবাদ তুঙ্গে উঠলে এই সংক্রান্ত সমস্যা সমাধানে বাংলার শাষনকর্তা মানসিংহ কিছুদিন এই দূর্গে বসবাস করেন। শেরপুরের এই ঐতিহাসিক স্থান বা ইতিহাসকে ধরে রাখতে স্থানীয় প্রশাসন ও সরকারের নজর দেওয়া প্রয়োজন বলে স্থানীয় সচেতন মহল মনে করছে।

লেখক : সম্পাদক, ই-ম্যাগাজিন নন্দিত শেরপুর এবং সাংবাদিক ও কবি, শেরপুর।

Leave a Reply

Scroll to Top